বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার আমাদের ভাষা ও সাহিত্যের ইতিবৃত্তে বিশেষভাবে উল্লেখ্যযোগ্য। সেটি সংঘটিত হয়েছিল ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে। ঐ সময় মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (১৮৫৩-১৯৩১) নেপালের রাজ দরবার থেকে একখানি প্রাচীন পুঁথি সংগ্রহ করেন। এই ঘটনার দশ বছর পরে তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে ‘বৌদ্ধ গান ও দোহা’ নামে ঐ পুঁথির বিষয়বস্তু নিজের সম্পাদনায় প্রকাশ করেন।
বৌদ্ধ গান ও দোহা নামে ওই সংগ্রহ গ্রন্থটিতে ছিল দুই ধরনের জিনিস- একটি ধর্ম সম্বন্ধীয় বিধিনিষেধ-বিষয়ক কিছু গান, অন্যগুলি দোহা। ধর্ম সম্বন্ধীয় বিধিনিষেধগুলির নাম ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’ অর্থাৎ ধর্ম সাধনার ব্যাপারে কোনগুলি আচরণীয় এবং কোনগুলি বর্জনীয় তারই নির্দেশ। দোহা গুলির রচয়িতা সরোজবজ্র এবং কৃষ্ণাচার্য। এই চর্যাচর্যবিনিশ্চয় বা চর্যাপদ এবং বৌদ্ধ ধর্মাচার্য সরোজবজ্র এবং কৃষ্ণাচার্য রচিত দোহাগুলি একসঙ্গে একই গ্রন্থের অন্তর্গত বলে আচার্য হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তার নাম দিয়েছিলেন ‘বৌদ্ধ গান ও দোহা’।
আরো পড়ুন: রেড বুল পান করুন আকাশে উড়ুন
চার্যাচর্যবিনিশ্চয়ের সংস্কৃত টীকাও পরে ঐ নেপালেই পাওয়া যায় এবং তার কিছুদিন পরে ডঃ প্রবোধচন্দ্র বাগচী চর্যাপদগুলির একটি তিবক্ষতী অনুবাদও একই দেশে আবিষ্কার করেন। চর্যাপদগুলির সংস্কৃত টীকা ও তিবক্ষতী অনুবাদ পাওয়া যাওয়ার পর সেগুলোর মূল্য এবং প্রামাণিকতাও নিঃসংশয়ে অনেক পরিমাণে বৃদ্ধি পেল।
মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী চর্যাপদের যে পুথিঁখানি সংগ্রহ করে আনেন, তাতে পদের সংখ্যা ৪৬-টি, একটি পদ খণ্ডিত- মোট সাড়ে ৪৬-টি।
আচার্য প্রবোধচন্দ্র বাগচী চর্যাপদের যে তিবক্ষতী অনুবাদ আবিষ্কার করেন। তাতে পদের সংখ্যা মোট ৫১-টি। মনে হয় চর্যাপদের মোট সংখ্যা একান্নটিই ছিল, পরে হয়তো কোনো কারণে তার কিছু অংশ নষ্ট হয়ে গিয়ে থাকবে।
চর্যাপদের কবিতাগুলি গদ্যকারের গ্রথিত গান। সেইজন্য চর্যাপদের অপর নাম চর্যাগান বা চর্যাগীতি। একজন কবি যেমন এই পদগুলি রচনা করেননি, তেমনি এক সুর এবং এক তালে এগুলো গেয় নয়। রচনাকাল সম্বন্ধে কোনও নির্দিষ্ট তারিখও পাওয়া যায় না। যে সমস্ত পদকর্তার গান চর্চাগীতি সংগ্রহের মধ্যে সংকলিত হয়েছে তাঁরা সবাই সিদ্ধাচার্য। মোট তেইশ জন সিদ্ধাচার্যের রচিত এক বা একাধিক পদাবলী নিয়ে প্রচলিত চর্যাপদের সংকলন সমাপ্ত। এই তেইশ জন সিদ্ধাচার্যের কে কয়টি গান রচনা করেছে তার তালিকাটি এইরকম,
কাহ্নুপাদ বা কৃষ্ণাচার্য ১৩-টি।
ভুসুকপাদ ৮-টি।
সরহপাদ ৪-টি।
কুক্কুরীপাদ ৩-টি।
এছাড়া লুইপাদ, সবরপাদ, শান্তিপাদ প্রত্যেককে দুটি করে এবং আর্যদের, কঙ্কনপাদ, কম্বলাম্বর, গুণ্ডরী বা গুড্ডরীপাদ, চাটিলপাদ, জয়নন্দী ডোম্বীপাদ, ডেন্টণপাদ, তন্ত্রীপাদ, তাড়কপাদ, দারিকপাদ, ধামপাদ, গুঞ্জরীপাদ, বিরুবাপাদ, বীণাপাদ, ভাদ্রপাদ বা মহীধরপাদ- প্রত্যেকের একটি করে গান চর্যাপদের মধ্যে সংকলিত হয়েছে।
চর্যাপদের গানগুলি যখন আচার্য হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর হাতে আসে, তিনি তার ভাষা দেখে নিশ্চিত ছিলেন যে, চর্যাপদের ভাষা বাংলা ছাড়া আর কিছুই নয়। সেই জন্যই চর্যাপদের পরিচয় প্রসঙ্গে তিনি বিনা দ্বিধায় বলেছেন, চর্যাপদের কবিতাগুলি ‘হাজার বছরের পুরাণ বাংলা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোহা’ ও ‘বৌদ্ধ সহজিয়া মতের অতি পুরাণ গান’। তিনি এগুলোকে বাংলা গান বলার সময় ভাষারতত্ত্বে বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিতে বিচার করেননি, করবার কথাও নয়। কারণ প্রচলিত অর্থে ভাষাবিজ্ঞানী তিনি ছিলেন না। তবে শাস্ত্রী মশাই কি বিনা কারণেই একমাত্র সহজ বুদ্ধির বশেই চর্যাগীতির ভাষাকে বাংলা বলেছিলেন?
তিনি সুস্পষ্ট দেখিয়েছেন, বাংলা ভাষার যে সমস্ত শব্দ বাগভঙ্গী এবং প্রকাশভঙ্গী তার নিজের বিশেষত্ব এবং সেই জন্যই বাংলা ভাষার spirit-এর সহধর্মী, সেই সমস্ত শব্দের বাগভঙ্গী এবং প্রকাশপদ্ধতি চর্যাপদে উজ্জ্বলভাবে উপস্থিত।
কিন্তু ভাষা বিজ্ঞানী কেবল vocables বা শব্দতত্ত্ব নিয়েই সন্তুষ্ট থাকেন না বা একমাত্র vocabels এর ওপর নির্ভর করেই কোনো ভাষার অনুশীলন বা জাতিনির্ণয় সম্ভব কিংবা সঠিক হতে পারে এরকম বিশ্বাস করেন না। কোনো ভাষার অনুশীলন করতে গেলে তার স্বরবিজ্ঞান বা phonology এবং পদগঠনরীতি বা morphology শব্দতত্ত্বের সঙ্গে সঙ্গে আলোচনা করা উচিত। বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি ভাষাবিজ্ঞানী আচার্য সমিতি কুমার তাই তার origin and development of the Bengali language গ্রন্থের চর্যাপদের ভাষা বাংলা কি না সেই সম্বন্ধে ভাষাতত্ত্বের দিক থেকে সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক আলোচনা করে আচার্য হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতকে প্রতিষ্ঠা করেছেন।
চর্যাপদের রচনাকাল নিয়েও ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের মাঝে মতবিরোধ রয়েছে। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ও প্রবোধচন্দ্র বাগচীর মত হচ্ছে চর্যারপদগুলি খ্রিস্টীয় ১০ম থেকে ১২শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে রচিত। কিন্তু ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও রাহুল সাংকৃত্যায়ন এই সময়কালকে আরও ২০০ বছর পিছিয়ে নেন। উনাদের মত চর্যাপদের রচনাকাল খ্রিস্টীয় ৮ম থেকে ১২শ শতাব্দী পর্যন্ত।
হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে ১০ম শতাব্দীর পূর্বে এটা রচনা হয়নি।
ওইদিকে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে হেবজ্রপঞ্জিকাযোগরত্নমালা নামে এক বৌদ্ধতান্ত্রিক পুঁথির সন্ধান পাওয়া যায়। যেটা রচনা হয় শেষ পালরাজা গোবিন্দপালের (১১৫৫ খ্রিস্টাব্দ) শাসনকালে।
এইসকল গুণীজনের মতামতের ভিত্তিতে চর্যারপদ খ্রিস্টীয় ১০ম থেকে ১২শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে রচনা হয়েছে বলেই অনুমান করা হয়। তবে তার পরেও দু-তিনশো বছর ধরে গোপনে চর্যাগীতি রচিত হয়েছিল।
আসুন চর্যাপদের একটি কবিতা মূল ভাষায় পাঠ করি।
রচনাঃ লুইপাদ
কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল।
চঞ্চল চীএ পইঠো কাল।
(কায়া অর্থাৎ দেহ বৃক্ষের মতো; পাঁচটি তার ডাল। চঞ্চল চিত্তে কাল অর্থাৎ মৃত্যু প্রবেশ করছে।)
দিঢ় করিঅ মহাসুহ পরিমাণ।
লুই ভণই গুরু পুচ্ছিঅ জাণ।
{চিত্ত দৃঢ় করে মহা সুখ পরিমাপ করো। লুই বলছেন, (কীভাবে তা করতে হবে) তা গুরুকে জিজ্ঞাসা করে জেনে নাও।}
সঅল সমাহিঅ কাহি করিঅই।
সুখ দুখেতেঁ নিচিত মরিঅই।
(সমস্ত সমাধিতে কী করো; সুখ-দুঃখে সে নিশ্চিত মরে অর্থাৎ সমাধিতে সাময়িকভাবে দুঃখের প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়া যায় কিন্তু সমাধি ভাঙলেই আবার সেই পূর্ববস্থা।)
এড়ি এউ ছান্দক বান্ধ করণক পাটের আস।
সুনুপাখ ভিড়ি লাহু রে পাস।
(এড়িয়ে যাও ছন্দের বা বাসনার বন্ধন ও করণের বা ইন্দ্রিয়ের পরিপাট্যের আশা, অর্থাৎ বাসনার বন্ধন এবং ইন্দ্রের পরিতৃপ্তির আশা পরিত্যাগ করো; শূন্য পাখা পাশে চেপে ধরো অর্থাৎ শূন্যতত্ত্ব বিচারের দিকে অগ্রসর হও।)
ভণই লুই আমূহে ঝাণে দিঠা।
ধমণ চমণ বেণি পাণ্ডি বইঠা।
(নুই বলছেন আমি সংজ্ঞায় বা ধ্যানে দেখেছি, ধমণ বা পূরক, চমণ বা রেচক দুই পিঁড়িতে আমি উপবিষ্ট।)