বিশ্বকাপ ফুটবল

বিশ্বকাপ ফুটবল এর কিছু বিতর্কিত মুহূর্ত

বিশ্বকাপ ফুটবল ‘দ্য ওয়ার্লডস বিগেস্ট শো’ নামে খ্যাত যা ঘিরে যেন মানুষের উৎসাহ উদ্দিপনা আর কৌতূহলের শেষ নেই। বিশ্ব ফুটবল প্রেমিদের কাছে – ফুটবল মানেই মনের ভিতর গচ্ছিত আবেগ এর বিস্ফোরণ ,অপেক্ষা, স্বপ্ন হাসি কান্না আর বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাস সম্প্রীতির উৎসব। বয়স কিংবা শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সব কিছুই যেন হার মেনে যায় ফুটবল উন্মাদনার কাছে । ফুটবল মানেই এক ভিন্ন দুনিয়া , বিস্ময় আর রোমাঞ্চকর ইতিহাস । যুগের পর যুগ হাজারো স্মৃতি এবং ইতিহাসের জন্ম দিয়েছে। প্রজন্মের পর প্রজন্মকে কখনো হাসিয়েছে, কখনো কাঁদিয়েছে বা ভাসিয়েছে আনন্দের স্রোতে । ফিফা বিশ্বকাপের সূচনা হয়েছিল ১৯৩০ সালে ।

ফুটবল বিশ্ব উপহার পেয়েছিল “পেলে-ম্যারাদোনা সহ অনেক লিজেন্ডদের, বিশ্ববাসী দেখেছে ব্রাজিলের শৈল্পিক দক্ষ পায়ের ম্যাজিক , আর্জেন্টাইনদের চোখ ধাঁধানো জাদুকরি পারফরমেন্স ,জার্মানীরক্ষুরধার মেধা যান্ত্রিক ফুটবল,স্পেনের টিকিটাকা,নেদারল্যান্ডের টোটাল ফুটবল। সব অভিজ্ঞতার সাক্ষী হয়ে আছে অজস্র সুন্দর মুহূর্ত। কিন্তু হাজার সুন্দর মুহূর্তের সহিত একটি মুদ্রার এপিট অপিটের ন্যায় অঙ্গাঙ্গী ভাবে ইতিহাসে ঠাই করে নিয়েছে কিছু

অনাকাঙ্কিত কলঙ্কিত ঘটনা।

প্রায় প্রতিটি বিশ্বকাপে শিরোপা অর্জনের লক্ষে বিতর্কিত লজ্জা জনক কর্ম কান্ডের জন্ম দিয়েছে অংশগ্রহণকারী অনেক দেশ। সাক্ষী হয়ে আছে ফুটবল বিশ্ব – আর্জেন্টাইন লিজেন্ড ম্যারাদোনার “hand of god” থেকে “disgrace of gijon” সহ বহুল অনাকাঙ্কিত কলঙ্কিত ঘটনার । Wrong decision of the referee, Life Ending Tackle, Match fixing এর মতো ঘটনাগুলো সর্বক্ষণ বিশ্বকাপের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ছিলো । আজকে আমরা বিশ্বকাপ ফুটবল এর কিছু বিতর্কিত কলঙ্কিত এবং স্মরণীয় মুহূর্ত তুলে ধরার চেষ্টা করছি ।

বিশ্বকাপ ফুটবল ১৯৬২ আয়োজক চিলি

১৯৬২ সালের বিশ্বকাপে ইতালি এবং চিলির মধ্যকার ম্যাচটাকে ফুটবল বিশ্বকাপের একটি কলঙ্কিত ম্যাচ বলা হয়ে থাকে। এই ম্যাচটিকে অবশ্যই ফুটবল ম্যাচ না বলে মার্শাল আর্ট প্রদর্শনী বলাই ভাল । ফ্লাইং কিক, কিল ঘুসি কি ছিল না সেই ম্যাচটিতে । মাঠের এই যুদ্দাবস্তা নিয়ন্ত্রণের জন্য তিনবার পুলিশের সাহায্য নিতে হয় রেফারিকে । ইতিহাসে এই ম্যাচটি ‘ব্যাটেল অব সান্তিয়াগো’ নামে পরিচিত । ম্যাচ শেষে ইতালি টিমকে পুলিশ প্রটেকশনে মাঠ থেকে বেরোতে হয় ।

ইতিহাসে এই ম্যাচটি ‘ব্যাটেল অব সান্তিয়াগো’ নামে পরিচিত । ম্যাচ শেষে ইতালি টিমকে পুলিশ প্রটেকশনে মাঠ থেকে বেরোতে হয় ।
ব্যাটেল অব সান্তিয়াগো

ফুটবল বিশ্বকাপ ১৯৬৬ আয়োজক ইংল্যান্ড 

ইংল্যান্ড ১৯৬৬ সালে প্রথমবারের মতো ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজন করে । তখনকার বিশ্বকাপ ট্রফির নাম ছিল জুলেরিমে ট্রফি সেটি ছিল ১০ সেন্টিমিটার উঁচু সোনার তৈরি পাখা ছড়ানো পরীর মূর্তি । বিশ্বকাপ শুরুর আগেই জুলেরিমে ট্রফিটি ইংল্যান্ড এ নিয়ে আসা হয় । কিন্তু ঘটে যায় ইতিহাসের এক লজ্জাজনক ঘটনা ।

লন্ডন ওয়েস্ট মিনিস্টার সেন্ট্রাল হলে এক প্রদর্শনী থেকে এই জুলেরিমে ট্রফিটি কাকতালীয়ভাবে চুরি হয়ে যায়। এডওয়ার্ড বেচলিনামক এক সাবেক সৈনিক এটি চুরি করে । পুলিশ তাকে ধরতে পারলেও ট্রফিটি আর খুঁজে পায়না । পরে লন্ডনের নরবুট এলাকার একটি পার্কে হেঁটে বেড়ানোর সময় ডেভিড করবেট এর পিকলেসই নামের একটি কুকুর সেই ট্রপিটি খুঁজে পায় । ইংল্যান্ডের মান সম্মান বাঁচিয়ে দেওয়ায় কুকুরটি বিখ্যাত হয়ে আছে বিশ্বকাপে হিরো হিসেবে ।

বিশ্বকাপ শুরুর আগেই জুলেরিমে ট্রফিটি ইংল্যান্ড এ নিয়ে আসা হয় । কিন্তু ঘটে যায় ইতিহাসের এক লজ্জাজনক ঘটনা ।
জুলেরিমে ট্রফি

ফুটবল বিশ্বকাপ ১৯৮২ আয়োজক স্পেন

২১শে জুন ১৯৮২ প্রথম রাউন্ডের ম্যাচে কোয়েত ও ফ্রান্সের মধ্যকার ম্যাচ এর দ্বিতীয়ার্ধে ঘটে বিশ্বকাপের কলঙ্কিত আরেকটি ঘটনা । ফ্রান্সের মিডফিল্ডার অ্যালাইন জিন গিরেসে যখন একটি গোল করেন, তার গোলকে কেন্দ্র করে বিতর্কের সূত্রপাত হয় । কুয়েতের খেলোয়াড়রা দাবি করেন যে তারা রেফারি বাঁশির আওয়াজ শুনে খেলা থামিয়ে দিয়েছিলেন, আর তখনই অ্যালাইন জিন গিরেসে গোলটি করেন এবং তারা গোল বাতিলের দাবি জানায় ।

এদিকে গ্যালারিতে বসে থাকা তৎকালীন কুয়েত ফুটবল ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট শেখ ফাহাদ আল-আহমাদ আল-সাবাহ মাঠে নেমে আসেন এবং কুয়েতের খেলোয়াড়দের মাঠ থেকে বেরিয়ে আসতে নির্দেশ দেন । এক পর্যায় তিনি রেফারির সঙ্গে তর্কে লিপ্ত হন অবশেষে রেফারি বাধ্য হয়ে সেই গোলটি বাতিল করে দেন । এ ঘটনার জন্য কুয়েতের আমিরকে দশ হাজার ডলার জরিমানাও গুনতে হয়েছিল ।

আরো পড়ুন: এক রহস্যময় গ্রাম আল-মাদাম

ফুটবল বিশ্বকাপ ১৯৮৬ আয়োজক মেক্সিকো

ডিয়াগো ম্যারাডোনা ফুটবল এর একজন জীবন্ত কিংবদন্তি । সেই ম্যারাডোনাই জন্ম দেন ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা বিতর্কের । এই বিশ্বকাপের কোয়াটার ফাইনালে মুখোমুখি হয় আর্জেন্টিনা এবং ইংল্যান্ড । দ্বিতীয়ার্ধে ৪ মিনিটের মাথায় ইংল্যান্ড এর ডি বক্স এর ভিতরে আসা বলকে হেড দিতে লাফিয়ে উঠেন ম্যারাডোনা এবং ইংল্যান্ড এর গোলরক্ষক পিটার শিলটন ।

আশ্চর্যজনক ভাবে পিটার শিলটনের চেয়ে ৮ ইঞ্চি খাটো ম্যারাডোনা হেড দিয়ে গোল করেন । পরবর্তীতে টিভি রিপ্লেতে দেখা যায়, ম্যারাডোনা হাত দিয়ে বলটিকে জালে পাঠাচ্ছেন । ম্যারাডোনার এই গোলটি ইতিহাসে “হ্যান্ড অব গড” নামে টিকে আছে।

পরবর্তীতে টিভি রিপ্লেতে দেখা যায়, ম্যারাডোনা হাত দিয়ে বলটিকে জালে পাঠাচ্ছেন । ম্যারাডোনার এই গোলটি ইতিহাসে "হ্যান্ড অব গড" নামে টিকে আছে ।
হ্যান্ড অব গড

ফুটবল বিশ্বকাপ ২০০৬ আয়োজক জার্মানি

বিশ্বকাপ ফুটবলের সবচেয়ে কলঙ্কিত ম্যাচের একটি ছিল বিশ্বকাপ ২০০৬ । জার্মানিতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ নেদারল্যান্ড ও প্রতুগাল দলের মধ্যকার ম্যাচটি । এই ম্যাচটির দায়িত্বে ছিলেন রাশিয়ান রেফারি ভ্যালেন্টিন ইভানভ । তিনি এই ম্যাচে খেলোয়াড়দের মধ্যে বল দখলের বদলে পরস্পরকে ফাউল করার দিকে বেশি নজর ছিল । রেফারি এই দুই দলের খেলোয়াড়দের মোট ষোলটি হলুদ কার্ড এবং চারটি লাল কার্ড দেখাতে বাধ্য হন ।

২০০৬ বিশ্বকাপে আরেকটি কেলেঙ্কারি ঘটনা ঘটে । ফ্রান্সে ও ইতালির মধ্যকার ফাইনাল ম্যাচে । নির্ধারিত সময়ে একেক গোল সমতা থাকায় খেলা গড়ায় অতিরিক্ত টাইমে । খেলার ১০৭ মিনিটের মাথায় ইতালির মার্কো মাতেরাজ্জি ফ্রান্সের তারকা খেলোয়াড় জিদানকে মায়ের নাম তুলে বাজে কথা বলেন, এতে ক্ষিপ্ত হয়ে জিদান ইতালির মাতেরাজ্জি বুকে মাথা দিয়ে প্রচন্ড আঘাত করে ফলে সরাসরি লাল কার্ড দেখে মাঠের বাইরে চলে যেতে হয় তাকে । পরে খেলায় পেনাল্টি শুট আউট হয় এবং ৫ঃ৩ গোলে হেরে যায় ফ্রান্স ।

জিদান ইতালির মাতেরাজ্জি বুকে মাথা দিয়ে প্রচন্ড আঘাত করে ফলে সরাসরি লাল কার্ড দেখে মাঠের বাইরে চলে যেতে হয় তাকে ।
জিদান ইতালির মাতেরাজ্জি বুকে মাথা দিয়ে প্রচন্ড আঘাত করে

ফুটবল বিশ্বকাপ ২০১০ আয়োজক দক্ষিণ আফ্রিকা

২০১০ বিশ্বকাপ এর কোয়াটার ফাইনালে মুখোমুখি হয় ঘানা এবং উরুগুয়ে । নির্ধারিত সময়ে খেলায় ১ঃ১ গোল শেষ হয়, ম্যাচ গড়ায়অতিরিক্ত সময়ে । খেলার অন্তিম লগ্নে এসে ঘানার স্ট্রাইকার ডমিনিক আদিয়াহ এর হেড থেকে বল যখন নিশ্চিত গোল লাইন অতিক্রম করছিলো, তখন উরুগুয়ের স্ট্রাইকার লুইস সুয়ারেজ ইচ্ছাকৃতভাবে হাত দিয়ে বল ঠেকান । যার ফলে সরাসরি লাল কার্ড দেখে মাঠ থেকে বেরিয়ে যেতে হয় তাকে কিন্তু পেনাল্টি থেকে গোল করতে ব্যর্থ হয় এবং পরবর্তীতে ট্রাইবেকারে তারা উরুগুয়ের কাছে পরাজিত হয় । এর জন্য লুইস সুয়ারেজ কাপুরুষোচিত আচরণের জন্য ব্যাপক নিন্দার সম্মুখি হন ।

ফুটবল বিশ্বকাপ ২০১৪ আয়োজক ব্রাজিল

এই বিশ্বকাপে আবারো কেলেঙ্কারির ঘটনায় উঠে আসে উরুগুয়ের স্ট্রাইকার সুয়ারেজের নাম । ম্যাচটি ছিল উরুগুয়ে ও ইতালির মধ্যে । এই ম্যাচের এক পর্যায়ে সুয়ারেজকে বল দখলে বাধা দিয়েছিল ইতালির কিয়েল্লিনি, রেগে গিয়ে সুয়ারেজ তিন কামড় দিয়ে বসে কিয়েল্লিনির কাঁধে । কিন্তু দৃশ্যটি রেফারির চোখ এড়িয়ে যায় বলে লালকার্ড দেখতে হয়নি সুয়ারেজকে । পরবর্তীতে টিভি রিপ্লেতে ঘটনাটি দেখা যায় । এই আচরণের জন্য চার মাসের জন্য নিষিদ্ধ করা হয় সুয়ারেজকে ।

এই ম্যাচের এক পর্যায়ে সুয়ারেজকে বল দখলে বাধা দিয়েছিল ইতালির কিয়েল্লিনি, রেগে গিয়ে সুয়ারেজ তিন কামড় দিয়ে বসে কিয়েল্লিনির কাঁধে ।
সুয়ারেজ তিন কামড়

শত বিতর্ক থাকলেও বিশ্বকাপ ফুটবল এর আবেদন অন্যরকম এই নিয়ে মানুষের উচ্ছাস ও উদ্দীপনা চিরকাল থাকবে । আমরা আশা করছি এবারের বিশ্বকাপ ২০২২ টি যেন কোন রকম কলঙ্কজনক ঘটনা ছাড়াই সুন্দরভাবে শেষ হয় । আপনার মূল্যবান সময় টুকু দিয়ে আমাদের অসময় ডট কম এর প্রথম পোষ্টটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *